টাইম ট্রাভেল কি সম্ভব? জানুন বিজ্ঞান কী বলে

টাইম ট্রাভেল, বা সময় পরিভ্রমণ, একটি ধারণা যা বহু বছর ধরে কল্পকাহিনী, সাহিত্য, ও চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রিয় বিষয় হয়ে উঠেছে। "ব্যাক টু দ্য ফিউচার", "ইন্টারস্টেলার", এবং "ডক্টর হু"-র মতো সিনেমা ও টিভি শো গুলোতে আমরা বারবার এমন চরিত্র দেখি যারা সময়ের গণ্ডি ভেদ করে অতীতে বা ভবিষ্যতে চলে যেতে পারে। কিন্তু বাস্তব জীবনে টাইম ট্রাভেল কি আসলেই সম্ভব? আধুনিক বিজ্ঞান কী বলে এই ধারণা সম্পর্কে? আসুন, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখি।

টাইম ট্রাভেল বলতে কী বোঝায়?

টাইম ট্রাভেল বলতে কী বোঝায়?

টাইম ট্রাভেল বলতে বুঝায় এমন এক প্রযুক্তি বা পদ্ধতি যা ব্যবহার করে একজন ব্যক্তি বা বস্তুর বর্তমান সময় থেকে অতীতে বা ভবিষ্যতে ভ্রমণ করা সম্ভব হয়। এটি সময়ের প্রবাহের সাধারণ নিয়মের বাইরে গিয়ে ভিন্ন সময়ে প্রবেশ করার ধারণা। যদিও এটি এখনো বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর একটি বিশাল অংশ, বিজ্ঞানীরা একে নিয়ে অনেক তত্ত্ব ও গবেষণা করেছেন।

আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব ও টাইম ট্রাভেল

টাইম ট্রাভেলের সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব (Theory of Relativity) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর দুটি আপেক্ষিক তত্ত্ব—বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব (Special Relativity) এবং সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব (General Relativity)—টাইম ট্রাভেল ধারণাকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে।

১. বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব (Special Relativity)

বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের মাধ্যমে আইনস্টাইন দেখিয়েছিলেন যে সময় ও স্থান একে অপরের সাথে যুক্ত। তিনি প্রমাণ করেন যে কোনো বস্তু আলোর বেগের কাছাকাছি গতি করলে সময় ধীরগতিতে চলে। একে বলা হয় "টাইম ডাইলেশন"।         

উদাহরণস্বরূপ, একটি মহাকাশযান আলোর কাছাকাছি গতিতে ভ্রমণ করলে সেই মহাকাশযানের ভিতরের সময় তুলনামূলকভাবে ধীর গতিতে চলবে, আর পৃথিবীতে সময় অনেক দ্রুত এগিয়ে যাবে। এটি ভবিষ্যতে টাইম ট্রাভেলের সম্ভাব্য পথ হিসেবে ভাবা যায়, কারণ মহাকাশযানে থাকা ব্যক্তি ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবেন।

২. সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব (General Relativity)

আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, মহাকর্ষ বল সময় ও স্থানকে বাঁকিয়ে দিতে পারে। এই ধারণা অনুযায়ী, খুব বেশি মহাকর্ষীয় বলের নিকটবর্তী হলে সময়ের প্রবাহ ধীর হয়ে যায়। যেমন, ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি গেলে সময়ের প্রবাহ ধীর হতে পারে। কিছু বিজ্ঞানী ধারণা করেন যে এই ব্ল্যাক হোলের ব্যবহার করে সময়ের ভিন্ন ভিন্ন বিন্দুতে সংযোগ তৈরি করা যেতে পারে, যাকে "ওয়ার্মহোল" বলা হয়।

ওয়ার্মহোল: টাইম ট্রাভেলের ফ্যান্টাসি?

ওয়ার্মহোল, যাকে "Einstein-Rosen Bridge" নামেও ডাকা হয়, একটি কাল্পনিক সময়-স্থান সুড়ঙ্গ যা মহাবিশ্বের দুটি ভিন্ন বিন্দুকে সংযুক্ত করতে পারে। যদি কোনোভাবে ওয়ার্মহোল তৈরি করা যায় এবং এটিকে স্থিতিশীল রাখা যায়, তবে এটি সম্ভবত টাইম ট্রাভেল করার একটি উপায় হতে পারে। তবে বর্তমান প্রযুক্তি দিয়ে এটি সম্ভব নয়। ওয়ার্মহোল স্থিতিশীল রাখতে "নেগেটিভ এনার্জি" বা নেতিবাচক শক্তির প্রয়োজন হবে, যা এখনো বিজ্ঞানীদের কাছে ধাঁধা হয়ে রয়েছে।

টাইম ট্রাভেলের চ্যালেঞ্জসমূহ

যদিও তাত্ত্বিকভাবে টাইম ট্রাভেল সম্ভব বলে মনে করা হয়, কিন্তু বাস্তবে এটির সম্ভাবনা নিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কিছু চ্যালেঞ্জের কথা নিচে আলোচনা করা হলো:

১. সময়ের প্যারাডক্স (Time Paradoxes)

টাইম ট্রাভেলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো "টাইম প্যারাডক্স"। যেমন, "গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স"-এর কথা ধরা যাক। আপনি যদি অতীতে ফিরে গিয়ে নিজের দাদাকে হত্যা করেন, তাহলে আপনি নিজেই কীভাবে জন্মাবেন? আবার, ভবিষ্যৎ থেকে ফিরে এসে বর্তমান পরিবর্তন করলে সেই পরিবর্তনের প্রভাব কী হবে? এ ধরনের প্যারাডক্সগুলো টাইম ট্রাভেলের ধারণাকে জটিল করে তোলে।

২. প্রচণ্ড পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন

টাইম ট্রাভেলকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রচুর পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হবে। আলোর বেগে ভ্রমণ বা ওয়ার্মহোল স্থিতিশীল রাখতে যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হবে তা বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নাগালে নেই। এমনকি যদি মহাবিশ্বের সব শক্তি ব্যবহার করাও সম্ভব হয়, তবুও এটি যথেষ্ট নাও হতে পারে।

কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও টাইম ট্রাভেল

কোয়ান্টাম মেকানিক্স, যা ক্ষুদ্র কণার আচরণ নিয়ে গবেষণা করে, টাইম ট্রাভেল সম্পর্কে কিছু নতুন চিন্তার পথ উন্মুক্ত করেছে। কোয়ান্টাম ফিজিক্সের কিছু তত্ত্ব, যেমন "কোয়ান্টাম সুপারপজিশন" এবং "মাল্টিভার্স থিওরি" অনুযায়ী, বিভিন্ন সময় ও স্থান সমান্তরালভাবে সহাবস্থান করতে পারে। মাল্টিভার্স থিওরি অনুযায়ী, প্রতিটি সিদ্ধান্তের ফলে নতুন একটি মহাবিশ্ব তৈরি হতে পারে। তাই এক মহাবিশ্ব থেকে অন্য মহাবিশ্বে গমন করলে হয়তো টাইম ট্রাভেল সম্ভব হতে পারে।

ভবিষ্যতের গবেষণা ও সম্ভাবনা

বর্তমানে টাইম ট্রাভেল বিজ্ঞানীদের কাছে একটি ধারণা মাত্র। তবে অনেক বিজ্ঞানী টাইম ট্রাভেল নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। যেমন, স্টিফেন হকিং টাইম ট্রাভেল নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং বলেছেন যে, ভবিষ্যতে হয়তো মানুষ এমন প্রযুক্তি আবিষ্কার করবে যা এই ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে। তবে বর্তমানে এটিকে বাস্তবে সম্ভব করা অনেক দূরের ব্যাপার।

টাইম ট্রাভেল কি আসলেই সম্ভব?

টাইম ট্রাভেল নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আইনস্টাইনের তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ব্যাখ্যাগুলো আমাদের কল্পনা করার সুযোগ করে দেয় যে, ভবিষ্যতে এটি কোনো একদিন হয়তো বাস্তবে রূপ নিতে পারে। তবে বাস্তবিকভাবে, বর্তমান প্রযুক্তি এবং জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে টাইম ট্রাভেল এখনো কল্পকাহিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। যদি আমরা ভবিষ্যতে আলোর গতির কাছাকাছি ভ্রমণ করতে সক্ষম হই বা ওয়ার্মহোলের রহস্য উদঘাটন করতে পারি, তবে হয়তো সময় ভ্রমণ আমাদের হাতের নাগালে চলে আসবে।

তবে যতদিন না আমরা এ বিষয়ে আরও গভীর জ্ঞান অর্জন করতে পারছি, টাইম ট্রাভেল বিজ্ঞান কল্পকাহিনী হিসেবেই থেকে যাবে।

আরও পড়ুন: 

* ক্রিপ্টোকারেন্সি কী

* বিকাশে ভুল নাম্বারে টাকা গেলে করণীয়

* ফ্রিল্যান্সিং শুরু করার আগে জেনে নিন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url